শরীরে দুর্গন্ধ কেন হয়? বাংলাদেশ গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চল হওয়ায় শীতের 2/1 মাস ছাড়া বাকি সময় ঘাম হওয়া খুব স্বাভাবিক বিষয়। ঘাম হলো গরমের সময় শরীরকে ঠাণ্ডা রাখার একটি স্বাভাবিক উপায়। কিন্তু এই স্বাভাবিক বিষয়টি অস্বস্তিকর হয়ে উঠতে পারে যদি ঘামের সাথে শরীরে দুর্গন্ধ বের হয়। অনেক সময় ব্যক্তি নিজের গায়ের গন্ধে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ায় তার গা থেকে শরীরে গন্ধ বেরোচ্ছে নাকি দুর্গন্ধ তা টের পান না। বিষয়টি অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলে তার আশেপাশের মানুষদের। কিছু বিষয়ে সচেতন হলে এ থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব। বিভিন্ন মেডিকেল গবেষণার ভিত্তিতে গায়ের দুর্গন্ধ হওয়ার কারণ এবং তার নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন বিষয়ে ব্যাখ্যা করছি আজ আমরা।
শরীরে দুর্গন্ধ কেন হয়?
ঘাম হলেই যে শরীরে দুর্গন্ধ হবে বিষয়টা একদমই তা নয়। কারণ ঘামের নিজস্ব কোন গন্ধ নেই। যুক্তরাষ্ট্রের ক্লিনল্যান্ড ক্লিনিকের তথ্যমতে, শরীরের ঘাম যখন ত্বকের সংস্পর্শে আসে তখনই শরীরে দুর্গন্ধের সৃষ্টি হয়। তাই আপনার ত্বকে কি ধরনের ব্যাকটেরিয়া আছে এবং সেটা ঘামের সাথে কিভাবে বিক্রিয়া করছে তার ওপর নির্ভর করে গন্ধ হবে কি হবে না। আবার ছোট শিশুদের গায়ে কখনো দুর্গন্ধ হয় না। সাধারণত বয়সন্ধি থেকে শরীরের বিভিন্ন অংশের লোম গজায় এবং ব্যাকটেরিয়া জন্ম নেয়। যা থেকে দুর্গন্ধ দেখা দেয়।
রিসেন্ট লাইভ খবর পেতে ফলো করুন আমাদের গুগল নিউজ চ্যানেল
ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক জোহান রুষ্টম শরীরের দুর্গন্ধ হওয়ার পেছনে মূলত পাঁচটি কারণকে দায়ী করেছেন। সেগুলো হলো জেনেটিক্স, শরীরে ব্যাকটেরিয়া সংখ্যা, খাদ্যাভ্যাস, ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা এবং আভাবা। এর বাইরে আরও কয়েকটি কারণকে শরীরের দুর্গন্ধের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক। সেগুলো হলো শরীরের অতিরিক্ত লোম, কেন না থাকলে ঘাম বেশি জমে থাকে, ফলে ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমনের সুযোগ বেড়ে যায়।
অতিরিক্ত ওজন, ব্যায়াম, মানসিক চাপ, ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া এবং বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যার কারণেও শরীরে দুর্গন্ধ হতে পারে। সাধারণত ডায়াবেটিস থাকলে রক্ত এসিডিক হয়ে যায়, আবার লিভার ও কিডনি রোগ থাকলে শরীরের দূষিত পদার্থ জমা হয়, বাত রোগ হলে শরীরে ইউরিক এসিড বেড়ে যায় , আবার মেনোপজ সময় হরমোন ওঠা নামার কারণে শরীরে গন্ধের পরিবর্তন হয়। তবে অভ্যাসও খাবারে কিছু পরিবর্তন আনলে গায়ের এ শরীরে দুর্গন্ধ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
গায়ে দুর্গন্ধ ও সুগন্ধের পেছনে যেসব খাবার দায়ীঃ
চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ডেবরা জেলমনের মতে, খাদ্যাভ্যাস গায়ের গন্ধের ওপর বড় প্রভাব ফেলে। সাধারণত কোন খাবার খাওয়ার দুই ঘন্টা পরে শরীরে সেটার প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বিভিন্ন গবেষণা ও মেডিক্যাল জার্নালে শরীরে দুর্গন্ধ হওয়ার পেছনে মদপান, অতিরিক্ত মাংস বিশেষ করে লাল মাংস খাওয়ার অভ্যাস, সেই সাথে পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, জিরা, মসলা কে দায়ী করা হয়েছে। এছাড়া অতিরিক্ত তেল, মসলাজাতীয় খাবার, প্রক্রিয়াজাত খাবার বা ফাস্টফুড, হট সস, ক্যাফিনযুক্ত খাবার, ভিটমেট অর্থাৎ ইনস্ট্যান্ট নুডুলস এর মসলা দেয়া হয় সেগুলো নিয়মিত খেলে শরীরে দুর্গন্ধ হতে পারে। জোহান মতে, মাংস, রসুন ও পেঁয়াজ প্রচুর সালফার থাকে। এ কারণে যারা নিয়মিত এসব খাবার খান তাদের শরীর থেকে সালফার বের হয় যা শরীরে দুর্গন্ধ সৃষ্টি করে।
তাই পেঁয়াজ, রসুন এর পরিবর্তে পুদিনা পাতা কিংবা ধনেপাতা খাওয়া যেতে পারে। কোন খাবার খেলে গায়ের দুর্গন্ধ দূর হয় এবং সুমিষ্ঠ গন্ধ ছড়ায়, সে বিষয়ে 43 জন পুরুষের ওপর গবেষণা করেছে অস্ট্রেলিয়ার ম্যাচের ইউনিভার্সিটি। তারা ঐ পুরুষদের সুতির শার্ট পরিয়ে এক ঘণ্টা ব্যায়াম করান। পরীক্ষা চলাকালে কাউকে কোন সুগন্ধি ব্যবহার করতে দেওয়া হয়নি।এছাড়া তাদের যে পরিহিত শার্টটি সেটিও কোন ডিটারজেন্ট এ ধোয়া হয়নি। ব্যায়াম শেষে তাদের ঘামে ভেজা শার্টের ওপর চলে গবেষণায়। দেখা যায়, যেসব পুরুষ বেশি বেশি ফল ও সবুজ শাকসবজি খেয়েছেন তাদের ঘামের গন্ধ সুমিষ্ট।
অন্যদিকে যারা মাংস, ডিম এবং তেল চর্বি জাতীয় খাবার খেয়েছেন তাদের ঘামে কিছুটা শরীরে দুর্গন্ধ আছে। কিন্তু যারা প্রচুর কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা জাতীয় খাবার খেয়েছেন তাদের ঘামে তীব্র দুর্গন্ধ পাওয়া গেছে। আরেকটি গবেষণায় একদল মানুষকে টানা দুই সপ্তাহ মাংসহীন ডায়েট দেয়া হয় এবং আরেক দলকে মাংস খেতে বলা হয়।
এতে দেখা যায় মাংসহীন ডায়েটে যারা আছেন, তাদের গায়ের গন্ধ তুলনামূলক সুমিষ্ট ও আকর্ষণীয়। এসব গবেষণা থেকে ধারণা করা যায়, সবুজ শাকসবজি, বিভিন্ন রঙিন ফলমূল এবং বিভিন্ন ধরনের মসলা গায়ের গন্ধকে প্রভাবিত করে। বিভিন্ন হেল্থ জার্নালের তথ্য মতে, সবুজ পাতা যুক্ত শাক, লেবু জাতীয় ফল, ডাল, গ্রিন টি, বিভিন্ন মসলা, যেমন মেথি, এলাচ, দারচিনি, লং ইত্যাদি খেলে শরীরের গন্ধ ভালো করা সম্ভব। সবুজ শাকসবজি শরীরের গন্ধ ছড়ালেও বাঁধাকপি, ফুলকপি, ব্রকলি, স্প্রাউট এর মত সালফারযুক্ত সবজি শরীরের দুর্গন্ধ সৃষ্টির জন্য দায়ী। তবে শরীরের দুর্গন্ধ উদ্রেককারী এসব খাবারের যথেষ্ট পুষ্টিগুণ আছে।তাই এসব খাবার ছেড়ে না দিয়ে কি পরিমাণে খাবেন সেটা একজন পুষ্টিবিশেষজ্ঞ থেকে জেনে নেবেন।
ব্যক্তিগত স্বাস্থবিধিঃ
প্রতিদিন অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল বা বেনজয়েল পারঅক্সাইড যুক্ত সাবান দিয়ে গোসল করলে বিশেষ করে শরীরের ভাঁজ গুলো পরিষ্কার রাখলে শরীরে দুর্গন্ধ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কেননা এতে গন্ধ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া গুলো নষ্ট হয়ে যায়। অনেকে আবার গোসলের পানিতে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল লিকুইড, গোলাপজল, লেবুর রস, গ্রীন অ্যাপেল সাইডার ভিনেগার মেশানোর পরামর্শ দেন। কিন্তু এর উপকারিতা আছে কিনা সে বিষয়ে কোনো মেডিকেল গবেষনা নেই। গোসল শেষে তোয়ালে ও গামছা দিয়ে শরীর সম্পূর্ণ শুকিয়ে নিতে হবে। গোসলের পর এবং ঘুমানোর আগে অ্যান্টিপারস্পিরেন্ট ডিওডোরেন্ট ব্যবহার করলেও কাজে দেবে। নিয়মিত বগলের লোম কামিয়ে রাখলেও দুর্গন্ধ এড়ানো যায়। কেননা এই অংশটি সবচেয়ে বেশি ঘামে এবং লোম থাকলে ঘাম দ্রুত শুকাতে পারে না। ফলে ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমনের সুযোগ বেড়ে যায়।
প্রতিদিন পরিষ্কার ধোয়া কাপড় অন্তর্বাস পরতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় সুতির ঢিলেঢালা পোশাক পরলে। এছাড়া ঘর্মাক্ত কাপড় সাথে সাথে ডিটারজেন্ট দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে। নিজের ব্যবহৃত তোয়ালে, গামছা, বিছানার চাদর, বালিশের কভার নিয়মিত হতে হবে। যাদের পা ঘামে দুর্গন্ধ হয়, তাদের ক্ষেত্রেও পায়ের নিয়মিত পরিচর্যার কোনো বিকল্প নেই। তাদের উচিত হবে খোলামেলা স্যান্ডেল পরা, যেন বাতাস চলাচল করে। যদি বন্ধ জুতা পরতে হয়, তাহলে প্রতিদিন পরিষ্কার সুতির মোজা দিয়ে পড়তে হবে। কোন অবস্থাতে আগে থেকেই ঘেমে থাকা ভেজা জুতা এবং অপরিষ্কার জুতা পরা যাবে না। প্রয়োজনে পায়ের সুগন্ধযুক্ত শ্রেয় পাউডার ব্যবহার করা যেতে পারে। চেষ্টা করুন ঠান্ডা জায়গায় এমন পরিবেশে থাকতে যেন ঘাম না হয়। ঘাম হলেও সেটি টিস্যু দিয়ে মুছে ফেলুন।
সেই সাথে মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি ও নজর দিন। কেননা মানসিক চাপের কারণে অনেক সময় ঘাম হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়, যা থেকে দুর্গন্ধ হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। এরপরও যদি গায়ের দুর্গন্ধ না কমে তাহলে হতাশ হবার কিছু নাই। এজন্য বাজারে সুগন্ধি তো আছেই। অতিরিক্ত যারা ঘামেন ও বিকট গন্ধ বের হয় তাদের জন্য বিভিন্ন ঔষধ, ইনজেকশন, লেজার থেরাপি, এমনকি অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থাও রয়েছে । চিকিৎসকরা সেটা রোগী বুঝে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তবে সেটি শুধুমাত্র বিশেষ ক্ষেত্রে। কারো গায়ের গন্ধ কেমন লাগবে সেটা নির্ভর করবে আপনার সাথে তার সম্পর্ক কেমন। যেমন বাসে আপনার পাশের সীটের ব্যক্তির গায়ের গন্ধ অপ্রীতিকর মনে হলেও আপনার সঙ্গীর কাছে কিংবা আপনার সন্তান বাবা বা মায়ের কাছে হয়তো সেটাই পছন্দের।
আবার প্রাচ্যে যে গন্ধের গ্রহণযোগ্যতা আছে, পাশ্চাত্যে সেটা নাও থাকতে পারে। এমন নানা ধরনের কনটেন্ট পেতে চোখ রাখুন আমাদের ওয়েবসাইটে।সেই সাথে আপনার আর কি কি ধরনের কনটেন্ট পেতে চান সে বিষয়ে কমেন্ট বক্সে জানাতে ভুলবেন না।