ইসলামের আছে এক সমৃদ্ধ অতীত। যখন গোটা ইউরোপ অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল, তখনও পৃথিবী কে জ্ঞানের অবায় আলোকিত করেছে ইসলামী স্বর্ণযুগ। গড়ে উঠেছে জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র বায়তুল হিকমা। এখানেই চর্চা হয়েছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানান শাস্ত্র।
আমরা জানবো ইসলামী স্বর্ণযুগ ও বায়তুল হিকমা
মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ফেরেশতা জিবরাঈল আলাইহিস সালাম প্রথম পড়ার ঐশী আদেশ নিয়ে আগমন করেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে। সেই থেকে পৃথিবীবাসীর কাছে জ্ঞান আহরণের আহ্বান ছড়িয়ে পড়ে থাকে মুসলিমদের মাধ্যমে। এভাবেই অন্ধকার যুগের নাগপাশ ছিঁড়ে পৃথিবীবাসী জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষতা অর্জন করে। আজকের আধুনিক বিজ্ঞানের উন্নতির পেছনে ও মুসলিম মনীষীদের অবদান দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। ইসলামিক খিলাফতকালে রাষ্ট্রীয়ভাবে জ্ঞানচর্চা কে সর্বোচ্চ উৎসাহ দেয়া হয়েছে। গড়ে উঠেছে বিভিন্ন জ্ঞান বিভিন্ন চর্চা কেন্দ্র।
রিসেন্ট লাইভ খবর পেতে ফলো করুন আমাদের গুগল নিউজ চ্যানেল
নবম শতকে সিরিয়ার বাগদাদে প্রতিষ্ঠিত বায়তুল হিকমা তাদের মধ্যে অন্যতম। এ সময়কালে মুসলিমদের ইসলামী স্বর্ণযুগ চলছিল এ যুগে মুসলিমদের হাত ধরে সাংস্কৃতিক অর্থনৈতিক এবং জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার সর্বোচ্চ সমৃদ্ধি ঘটে।
মসজিদুল আকসার ইতিহাস ও আদ্যোপান্ত
পবিত্র কোরআন ও হাদিসের বিভিন্ন জায়গায় জ্ঞান অর্জনের উপর গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। ইসলামী মূল্যবোধে অনুপ্রাণিত হয়ে মুসলিম বিজ্ঞানী এবং গবেষকরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রায় সকল শাখায় অনুসন্ধান চালিয়ে ছিলেন। বলা হয় সত্যি কারের বৈশ্বিক সভ্যতা মুসলিমরাই প্রথম তৈরি করেছিলেন। যা জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার জন্য বিশ্বের বহু প্রান্ত থেকে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে জ্ঞানী বিজ্ঞ মানুষদের মিলন ঘটাতে পেরেছিল।
ইসলামী স্বর্ণযুগ জ্ঞান ও বিজ্ঞান
ইসলামী স্বর্ণযুগের ব্যাপ্তিকাল নিয়ে নানান মতভেদ থাকলেও বেশিরভাগ ইতিহাসবিদের মতে অষ্টম শতাব্দী থেকে চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত ছিল মুসলিমদের ইসলামী স্বর্ণযুগ। যার শুরু ধরা হয় মদিনায় প্রথম ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং ইসলামী শক্তির উত্থানের সময় থেকে। আর ১২৫৮ সালে হিংস্র মোঙ্গলদের দ্বারা জ্ঞানের শহর বাগদাদ অবরোধ এর সময়কে শেষ ধরা হয়।
ইসলামী স্বর্ণযুগে বৈজ্ঞানিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সামরিক এবং সাংস্কৃতিক অগ্রগতিতে মুসলিমরা ছিল অপ্রতিদ্বন্দী। সে সময় জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় পারদর্শী এক পন্ডিত শ্রেণী গড়ে উঠেছিল যারা হেকিম বলে পরিচিত ছিলেন। সে যুগে মুসলিম পণ্ডিতরা এক এক জন বহু বিষয়ে অভিজ্ঞ এবং বিদ্বান ছিলেন।
তৎকালীন সময়ে কবি সাহিত্যিক চিকিৎসক বিজ্ঞানী প্রকৌশলী পন্ডিত চিত্রকর দার্শনিক ভূতত্ত্ববিদ বণিক পর্যটকরা তাদের মেধা দক্ষতা এবং যোগ্যতার দ্বারা চিকিৎসা শিল্প-সংস্কৃতি ব্যবসা-বাণিজ্য কৃষি অর্থনীতি আইনশাস্ত্র সাহিত্য দর্শন বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অবদান রেখে ইতিহাসে নিজেদের নাম অমর করে রেখে গেছেন। যা পরবর্তীতে মানব সভ্যতার অগ্রগতিতে অগ্রণী ভূমিকা রাখে।
যেমন বীজগণিতের জনক হলেন মুসা আল খাওয়ারিজমী, আলোক বিজ্ঞানের জনক ইবনে হাইসাম সার্জারি, ও নিউরো সার্জারির পথপ্রদর্শক আলজাহরা বি, মহাকাশ বিষয়ে পাণ্ডিত্য রাখেন নাসিরুদ্দীন তুসী, এছাড়াও আধুনিক মুলমুল শাখার উদ্ভব এবং উন্নতি সাধনে আরো অনেক মুসলিম জ্ঞানতাত্ত্বিক অবদান রাখেন। মোটকথা এটাই বাস্তব যে মুসলিম বুদ্ধিজীবি এবং গবেষকদের দ্বারা নতুন নতুন জ্ঞান বিজ্ঞানের শাখা উদ্ভাবিত না হলে বর্তমান আধুনিক পৃথিবীর জন্মই হতো না।
ইসলামী স্বর্ণযুগে অন্যতম বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার কেন্দ্র বাগদাদের বায়তুল হিকমা বা হাউজ অফ উইজডম। আব্বাসীয় খেলাফতের সময় খলিফা হারুনুর রশিদ 786 থেকে 809 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের বাগদাদে এই জ্ঞান চর্চা কেন্দ্র গড়ে তোলেন। তখনকার সময়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এই গ্রন্থাগার অনুবাদ কেন্দ্র এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভারত-চীন, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা-ইউরোপ সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে মুসলিমদের পাশাপাশি অমুসলিম জ্ঞানপিপাসু জ্ঞান অর্জনের জন্য আসছেন।
এখানে মেসোপটেমীযয়া রোমান, চীন, ভারতীয়, পারসি মিশরীয় উত্তর আফ্রিকা এবং বাইজেন্টাইন সভ্যতার সহ পৃথিবীর সকল অঞ্চলের প্রাচীন সংরক্ষণ করে গবেষণা করার পাশাপাশি গবেষণালব্ধ জ্ঞান শিক্ষা দেয়া হতো। .
এ জন্য প্রথমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে মূল্যবান গ্রন্থ সংগ্রহ করে তারা তা আরবি ভাষায় অনুবাদ করতেন। এরপর আরবি থেকে তুর্কি, সিন্ধি, ল্যাটিন, ফার্সি, হিব্রু ইত্যাদি নানান ভাষায় অনুবাদ করা হতো।
ইসলামী স্বর্ণযুগে আল মামুনের শাসনামল
813 থেকে 833 খ্রিস্টাব্দে খলিফা হারুনুর রশিদের পুত্র আল মামুনের শাসনামলের সময়ে এটি জ্ঞানচর্চার সর্বোচ্চ শিখরে পোঁছায়। খলিফা আল মামুনের শাসনামলে গবেষণার জন্য মান মন্দির স্থাপিত হয়। এসময় গণিত, জ্যোতিসবিদ্যা, বিজ্ঞান, আলকেমি, প্রাণিবিদ্যা, ভূগোল এবং মানচিত্রাঙ্কন বিদ্যা সহ বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান চর্চার জন্য বায়তুল হিকমা অপ্রতিদ্বন্দ্বী স্থান হয়ে ওঠে। এমনকি নবম শতকের মধ্যভাগে বায়তুল হিকমা হয়েছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গ্রন্থ ভান্ডার।
ইসলামী স্বর্ণযুগ ও বায়তুল হিকমা
তৎকালীন সময়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানের যথাযথ কদর করা হতো লোকমুখে কথিত আছে বায়তুল হিকমার জন্য কেউ ভিন্ন ভাষার উপকারী বই অনুবাদ করে নিয়ে আসলে তাকে পুরস্কার হিসেবে সেই বইয়ের ওজন পরিমাণ স্বর্ণ দেওয়া হতো। ফাতেমীয় যুগে অর্থাৎ 909 থেকে 1171 সাল পর্যন্ত মুসলিম বিশ্বের রাজধানী শহর বাগদাদ, কায়রো, কর্ণবাজা, বিজ্ঞান, দর্শন, বাণিজ্য, শিক্ষার বুদ্ধিবৃত্তিক কেন্দ্রে পরিণত হয়। তখন মুসলিমরা তাদের অধিকৃত অঞ্চলের বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। এমন নজিরও আছে যে শক্তিশালী ইসলামী সাম্রাজ্য বই বিনিময় চুক্তির মাধ্যমে অমুসলিম শাসিত অঞ্চল যুদ্ধ থেকে মুক্তি দিয়েছে।
হজের সময় আরবে সারা বিশ্বের মুসলিমদের মিলনমেলা হত। সেখানেও তারা বৈশ্বিকভাবে নিজস্ব চিন্তা এবং আঞ্চলিক গান আদান প্রদান করতেন। আবার আরব বণিকরা পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ব্যবসার কাজে গিয়ে প্রযুক্তিগত জ্ঞান সংগ্রহ করে নিয়ে আসতেন। এভাবে জ্ঞানের জন্য তৃষ্ণার্ত মুসলিমদের হাত ধরেই জ্ঞান বিজ্ঞানের সকল শাখার উন্নতি ঘটে।
ইসলামী স্বর্ণযুগের জ্ঞান চর্চা কেন্দ্র বায়তুল হিকমা গবেষক হিসেবে তিনজন আপন ভাই নিয়োজিত ছিলেন। আবিষ্কারের ইতিহাসে তারা তিনজন খুবই বিখ্যাত। তাদেরকে একত্রে বলা হতো ‘বনু মুসা’।
বর্তমান রোবটিক সাইন্স এর জনক বলা হয় তাদেরকে। মুসলিমদের নেতৃত্বে বাগদাদ কেন্দ্রিক জ্ঞান-বিজ্ঞান তরতর করে অগ্রসর হচ্ছিল। কিন্তু মোঙ্গলদের অনাকাঙ্ক্ষিত আক্রমণে ধ্বংস হয় ইসলামিক জ্ঞানের শহর বাগদাদ। এভাবেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের নেতৃত্বে আসন হাতছাড়া হয় মুসলিমদের।