এমন কোন রান্নাঘর খুজে পাওয়া অসম্ভব যেখানে পেয়াজ নেই। কেননা কোন রান্না করতে গেলে কড়াইতে তেল দেওয়ার পর প্রথমেই পেঁয়াজ দিতে হয়। শুধু রান্না করার ক্ষেত্রেই নয়, কাঁচা খেতেও এ মশলাটি অনেক সুস্বাদু।এসব ছাড়াও আচার, ভর্তা, এমনকি সালাদ বানাতেও এ মসলাটির কদর কম নয়। বেশ কিছু স্বাস্থ্যগুনও রয়েছে এ পেঁয়াজে। বাংলাদেশ তো বটেই, সবকিছু মিলিয়ে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই এ পেয়াজের চাহিদা রয়েছে ব্যাপক।
পেঁয়াজ আসলে কি?
কোন সবজি নয়। এটি একটি মসলা জাতীয় উদ্ভিদ। এর বৈজ্ঞানিক নাম ”এলিয়াম সেপা”। এই বর্গের অন্যান্য উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে রসুন, লীগ এবং চিনা পিয়াজ। রসুন এর মতই এর গোত্র হচ্ছে ”লিলি”।
পেঁয়াজ কোথায় উৎপন্ন হয়?
এটি এমন একটি উদ্ভিদ, যা বিশ্বের প্রায় সব দেশেই উৎপাদিত হয়। সবচেয়ে বেশি এই মসলাটি উৎপাদিত হয় ভারত এবং চীনে। শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের হার্টিকালচার বিভাগের শিক্ষক এফ এম জামাল ঊদ্দিন বলেছেন, সেসব দেশগুলোতে প্রধানত এই মসলাটি উৎপন্ন হয় যেখানে বেশি বৃষ্টি হয় না। পাশাপাশি হালকা শীত থাকে। সেজন্যই বাংলাদেশে এই মসলাটি হয় শীতকালে। সেই সময় দামও কম থাকে।
বাংলাদেশে কি ধরনের পেয়াজ উৎপাদিত হয়?
বাংলাদেশের যেসব এলাকায় শীত বেশি থাকে, সেসব এলাকায় এই মসলাটি বেশি জন্মায়। জামাল ঊদ্দিন বলেছেন, বাংলাদেশে এলিয়াম,সেপা বা এই মসলাটি ।যা মূলত একটা বাল্ব। সেটাই উৎপাদিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশের এই মসলাটি তেমন বড় হয় না। আকারে বড় না হলেও বাংলাদেশের এই মসলাটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি ঝাঁঝালো বেশি হয়। কারণ এতে এলিযসিনের মাত্রা বেশি থাকে।যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। এজন্য বাংলাদেশের এই মসলাটি ব্যবহার করে রান্নাটা বেশী মজা হয়, উল্লেখ করছেন বিশেষজ্ঞরা।
পেঁয়াজের খাদ্যগুন কী কী?
পুষ্টিবিদ রা বলছেন, পেঁয়াজ আসলে মসলা জাতীয় খাবার। এর মূল উপাদান পানি, কার্বোহাইড্রেট ও ফাইবার তবে এই মসলাটি পানির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি থাকে। প্রায় 85 শতাংশ। এছাড়াও পুষ্টিগুণ বলতে গেলে ভিটামিন সি,, বি এবং পটাশিয়াম থাকে। এই মসলাটি খোসা ছাড়ালে যে গাঢ় বেগুনি রঙের একটি আস্তরণ পাওয়া যায়, তাতে বেশি পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে।
জ্বালাপোড়া বা প্রদাহ নিবারণ করে এরকম উপাদান রয়েছে এই মসলাটি। এটি হাড়েরও সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করে। পুষ্টিবিদদের মতে, শরীরে পটাশিয়াম এবং মিনারেল বা ও খনিজের চাহিদা পূরণের একটি ভালো উৎস এই মসলাটি। এই উপাদানগুলো অনেক বেশি পরিমাণে থাকে। এছাড়া প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি থাকে। ডাইডারি ফইবার থাকে অনেক বেশি যা প্রায় 12 শতাংশ। এই মসলাটি মধ্যে কোন ফ্যাট নেই। এছাড়া প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ, বি এবং আয়রন পাওয়া যায়।
রান্নায় পেঁয়াজ কী স্বাদ যোগ করে?
পেঁয়াজে যেহেতু সালফার উপাদান থাকে, তাই এটি রান্নায় এক ধরনের ঝাঁঝালো স্বাদ যোগ করে। তবে নিজস্ব স্বাদ যোগ করা ছাড়াও রান্নায় এই মসলাটি এর সবচেয়ে বড় কাজ হচ্ছে রান্নার অন্যান্য উপকরণের স্বাদ অনেক বেশি বাড়িয়ে দেয়।
দীর্ঘক্ষন রান্না করলে কি খাদ্যগুণ নষ্ট হয়ে যায়?
পেঁয়াজে নানা ধরনের ভিটামিন ও প্রাকৃতিক তেল থাকে যা রান্নার পর নষ্ট হয়ে যায় বলে ধারণা করা হয়। তবে পুষ্টিবিদরা বলছেন, এই মসলাটি ভোলাটাইল কিছু উপাদান রয়েছে যেগুলো নাকে-মুখে লাগে, সেগুলো হয়তো নষ্ট হয়। কিন্তু এই মসলাটি অন্য উপাদান গুলো নষ্ট হয় না। খোলা রান্না করলে বা কেটে খোলা রাখলে এই মসলাটি খাদ্যগুণ নষ্ট হয় না। তবে সালফার কম্পনেন্ট কমে আসে।
রান্নার পর খোলা অবস্থায় রাখলে কোন সমস্যা হয়না। পুষ্টিবিদ্যা বলছেন, বেশিক্ষণ ধরে রান্না করা হলে ভিটামিন ও পটাশিয়াম কমে আসতে পারে। এ ছাড়া বাকি সব খাদ্য উপাদান নষ্ট হয় না। তবে উচ্চ তাপমাত্রায় রান্না করলে খাদ্যগুণ নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে বলে, মধ্যম তাপমাত্রায় এই মসলাটি রান্না করার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। এই মসলাটি গুণাগুণ পেতে হলে কাঁচা এই মসলাটি খাওয়ার অভ্যাস বেশি করতে হবে বলেও উল্লেখ করেন অনেক পুষ্টিবিদ।
পেঁয়াজ কাটলে চোখ দিয়ে পানি পড়ে কেন?
পেঁয়াজ কেটেছেন কিন্তু চোখে পানি আসে নি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া বেশ কষ্টকর। মি.জামাল উদ্দীন বলছেন, এই মসলাটি ভোলাটাইল কোম্পাউন্ট যা এলিসীন নামে পরিচিত, এই মসলাটি ঝাঁজ এর জন্য দায়ী। আর কাটার সময় এটি চোখে লাগে বলে চোখে জ্বালাপোড়া করে এবং পানি পরে। তিনি বলছেন, জাপান বা অন্য দেশে এই মসলাটি বড় মাপের হয় এবং সেগুলোতে এলিসীনের এর মাত্রা কম থাকার কারণে সেখানে পেঁয়াজ কাটলে চোখ জলে না। এসব দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কাঁচা খাওয়া হয় সবজি হিসেবে।
পেঁয়াজ কি ঔষুধি গুণ থাকে?
পেঁয়াজের ঔষুধি গুণ কি? ঐতিহাসিকভাবে এই মসলাটি রয়েছে ঔষধি ব্যবহার। প্রাচীন আমলে কলেরা এবং প্লেগের প্রতিরোধক হিসেবে ব্যবহার করা হতো এই মসলাটি ৷ প্রাচীন রোমান সম্রাট নিরো, ঠান্ডার ওষুধ হিসেবে এই মসলাটি খেতেন বলেও জনশ্রুতি রয়েছে।
পেঁয়াজে থাকা এলিসীন নামের উপাদান এন্টিফাঙ্গাল এবং অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল হিসেবে কাজ করে। অনেক সময় এটি কিছু কিছু ক্যান্সার প্রতিরোধক হিসেবেও কাজ করে। হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস, রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ঠিক রাখা, ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষেত্রে এই মসলাটি ব্যবহার দেখা যায়। বাংলাদেশের শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মি. জামাল উদ্দিন বলছেন, এই মসলাটি কাঁচা খেলে সর্দি, কাশি খুব কম পরিমাণে হয়। এটি মানুষের শরীরের রোগ প্রতিরোধক হিসেবেও কাজ করে।
পেঁয়াজের গন্ধ দূর করবেন কিভাবে?
অনেক সময় এই মসলাটি কাটলে বা কাঁচা এই মসলাটি খেলে হাতে এবং নিঃশ্বাসে দুর্গন্ধ হয়।। এর জন্য অনেক সময়ই এই মসলাটিকে এড়িয়ে চলি আমরা। তবে কিছু পদ্ধতি অবলম্বন করলেই এই মসলাটি এই দুর্গন্ধ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। হাতে গন্ধ হলে এই মসলাটি কাটার পর প্রথমে ঠান্ডা পানি দিয়ে হাত ধুতে হবে। তারপর লবণ দিয়ে হাত কচলে আবার ধুয়ে ফেলতে হবে। এরপর সাবান এবং গরম পানি দিয়ে হাত ধুয়ে নিলে থাকবে না কোন গন্ধ। নিঃশ্বাসের গন্ধ দূর করতে হলে ধনেপাতা বা একটি আপেল খেয়ে নিলে দূর হয়ে যাবে তাও।