মসজিদুল আকসার ইতিহাস ও আদ্যোপান্ত

মসজিদুল আকসার ইতিহাস ও আদ্যোপান্ত; মসজিদুল আকসার ইতিহাস; মসজিদুল আকসার; আকসার ইতিহাস; recentlive.com; recentlive; Recent Live;

মসজিদুল আকসার ইতিহাস: আমাদের ৩য় পবিত্র মসজিক এবং আমাদের প্রথম কেবলা হলে মসজিদুল আকসা বা বায়তুল  মুুকাদ্দাস। বায়তুল্লাহ  মক্কায় প্রথম নির্মাণ করেন  আদি পিতা আদম আলাইহওস সালাম।  জেরুজালেমে ঠিক ৪০ বছর পর  মাসজিদুল আকসা নির্মান করেন। হিজরতের ১৬ কিংবা ১৭ মাস পর  বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে মুসলমানদের কিবলা মক্কার দিকে  স্থায়ী ভাবে পরিবর্তন হয়।

মসজিদুল আকসার ইতিহাস

মাসজিদুল আকসা বা বাইতুল মুকাদ্দাস আমাদের তৃতীয় পবিত্র মসজিদ এবং প্রথম কিবলা। পবিত্র কুরআনুল কারীমে মক্কা মসজিদুল হারামের সাথে মসজিদুল আকসার উল্লেখ এসেছে।

সূরা বনী ইসরাইলের প্রথম আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি তাঁর বান্দাকে রাত্রিবেলায় ভ্রমণ করেছেন মসজিদে হারাম থেকে মাসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার চারদিক আমি বরকত দান করেছি যাতে আমি তাকে আমার কিছু নিদর্শন দেখাতে পারি। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা এবং সর্বদ্রষ্টা।

মসজিদুল আকসার ইতিহাসে জেরুজালেমের অবস্থান

মসজিদুল আকসার মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তিনের জেরুজালেম শহরে অবস্থিত। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় জেরুজালেম শহর অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। অসংখ্য নবী রাসূলগণের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও পৃথিবীর বুকে টিকে আছে জেরুজালেম। জেরুজালেমের কথা হাদিসে অনেক বার উল্লেখ করা হয়েছে।

আদি পিতা হযরত আদম (আঃ) প্রথম ইবাদতের স্থান বাইতুল্লাহ নির্মাণ করেন মক্কায়। এর ঠিক চল্লিশ বছর পর জেরুজালেমে মাসজিদুল আকসা নির্মাণ করেন। মাসজিদুল আকসা অর্থ দূরবর্তী মাসজিদ। কাবাঘর বায়তুল্লাহ থেকে দূরবর্তী হওয়ায় এটিকে মাসজিদুল আকসা নামে নামকরণ করা হয়। আগে এর নাম ছিল বাইতুল মুকাদ্দাস বা বাইতুল মাকদিস। এর নাম গুলো হচ্ছে আল-কুদস, মসজিদে ইলিয়া, সালাম, ইয়াবুজ এবং যুগে যুগে এ পর্যন্ত ২২ বার আল-আকসা মসজিদ পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে।

কোরআনে তাকওয়া অবলম্বনের সুসংবাদ

মসজিদুল আকসার ইতিহাসে পুনর্নির্মাণ

মসজিদুল আকসার ইতিহাসে পুনর্নির্মাণ

খ্রিস্টপূর্ব ১০০৪ সালে হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম মসজিদটি পুনর্নির্মাণ করেন। পুনর্নির্মাণের ক্ষেত্রে তিনি জিনদের নিয়োগ করেন। সমুদ্রের তলদেশ থেকে জিনদের মাধ্যমে মূল্যবান পাথর এনে মাসজিদুল আকসা পুনর্নির্মাণ করা হয়। দুইটি বড় দশটি ছোট গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটিতে প্রকাশ পেয়েছে নির্মাণশৈলীর এক মনমুগ্ধকর প্রতিচ্ছবি। বিভিন্ন সময়ে মাসজিদটি সংস্কারে ব্যবহার করা হয়েছে মার্বেল সোনা সহ নানান ধরনের মূল্যবান ধাতু ও পাথর।

মসজিদুল আকসার ইতিহাসে পবিত্র স্থান মুসলিম এবং ইহুদিদের জন্য

আল-আকসা চত্ত্বরে ‘কুব্বাতুস সাখরা’ তথা ‘ডোম অফ দ্য রক’ নামেও একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা রয়েছে। ষোড়শ শতকে তুর্কি সুলতান সুলেমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট জেরুজালেম শহরের পবিত্র বায়তুল মুকাদ্দাসের ‘কুব্বাতুস সাখরা’ স্থাপনার মোজাইকের আবরণ বদলে নীল টাইলস স্থাপন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

তিনি সেই টাইলসের উপর দিয়ে পবিত্র কুরআনের সূরা ইয়াসীন খোদাই করার ব্যবস্থা করেছিলেন। ‘ডোম অফ দ্য রক’ স্থাপনাটি ইহুদি এবং মুসলিমদের কাছে পবিত্র। ইহুদিরা বিশ্বাস করে এই স্থাপনার ভেতরে অবস্থিত পাথরটি থেকে মহাবিশ্বের সূচনা শুরু। অর্থাৎ এটি কেন্দ্র এবং পৃথিবীর প্রথম পাথর।অন্যদিকে মুসলিম বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বলা হয়ে থাকে এটাই সম্ভবত সেই পাথর, যার উপর পা রেখে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিরাজের রাত্রিতে ওর ধারণ করেন। এর কাছে রয়েছে গোল্ডেন গেট। যার মধ্য দিয়ে বায়তুল মুকাদ্দাস প্রাঙ্গণে প্রবেশ করা যায়। এই গেট দিয়ে ঈসা আলাইহিস সালাম জেরুজালেমে প্রবেশ করেছিলেন।

ইহুদি বিশ্বাস অনুযায়ী, এই গোল্ডেন গেট এর মধ্য দিয়ে তাদের মাসিহ দাজ্জাল প্রবেশ করবে। সুলতান সুলেমান এই টাইলস বসানোর পাশাপাশি আরেকটি কাজ করেন। তিনিই গেট বন্ধ করে দেন। কারণ তিনি ধারণা করেছিলেন, এই গেট দিয়ে কেয়ামতের পূর্বে মুসলিমদের জন্য সবচেয়ে বড় ফিতনা দাজ্জাল প্রবেশ করবে।

মসজিদুল আকসার ইতিহাসে রাসুল সাঃ মিরাজ ভ্রমণ

মুসলিম জাহানের কাছে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মিরাজ ভ্রমণের রাতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদুল হারাম থেকে আল-আকসা মসজিদে এসেছিলেন। এখান থেকেই তিনি উর্দু আকাশের দিকে যাত্রা করেন এবং পৃথিবীর রহস্য ভেদ করে আল্লাহ তা’আলার সাথে সাক্ষাৎ করেন। সেই রাতকেই পবিত্র শবে মি’রাজ বলা হয়। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিরাজে গমনের প্রাক্কালে এই মসজিদের সব নবী রাসূলগণের ইমামতি করে নামাজ আদায় করেছেন। এতে তিনি ইমামুল আম্বিয়া অর্থাৎ সকল নবীর ইমাম ও সাইয়েদুল মুরসালিন অর্থাৎ সব রাসুলের নেতা হিসেবে স্বীকৃত হন।

জেরুজালেম এলাকাটি অসংখ্য নবী রাসূলগণের স্মৃতিবিজড়িত। এর আশপাশে অনেক নবী রাসূলের কবর রয়েছে। প্রাচীন কাল থেকেই এই অঞ্চলটি ওহী অবতরণের স্থল, ইসলামের কেন্দ্র, ইসলামী সাংস্কৃতিক, চারণভূমি এবং ইসলাম প্রচারের লালন ক্ষেত্রের হিসেবে প্রসিদ্ধি। মাসজিদুল আকসা এক রাকাত নামাজ আদায় করলে ২৫০ রাকাত অন্য বর্ণনায় ৫০০ রাকাত নামাজ আদায়ের সওয়াব পাওয়া যায়।

মসজিদুল আকসার ইতিহাসে মুসলিমদের কেবলা

আল-আকসা মসজিদ গুরুত্বের আরো একটি বড় কারণ হল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুয়ত প্রাপ্তির পর থেকে টানা ১৪ বছর পর্যন্ত আকসা মসজিদে ছিল মুসলিমদের কেবলা। মুসলিমদেরকে হিজরতের ১৬ – ১৭ মাস পর মহান আল্লাহতালার নির্দেশে মুসলিমদের কিবলা বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে মক্কার দিকে স্থায়ীভাবে পরিবর্তন হয়। ইহুদীদের কাছে এই স্থানটি টেম্পল মাউন্ট হিসেবে পরিচিত, তাদের দাবি এর নিচেই রয়েছে তাদের দুটি প্রাচীন মন্দির। অন্যদিকে খ্রিস্টানরাও আল-আকসা মসজিদের স্থাপনাকে তাদের পবিত্র স্থান হিসেবে দাবি করে আসছে।

মসজিদুল আকসার ইতিহাসে ইসলামী শাসন

জেরুজালেম শহর সুদীর্ঘকাল শাসন করেছে বাইজেন্টাইন খ্রিস্টান শাসকেরা। ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু ইয়ারমুকের যুদ্ধের মাধ্যমে তাদের হাত থেকে জেরুজালেম শহর এবং মুসলিমদের প্রথম কিবলা মাসজিদুল আকসা কে মুক্ত করেন। এরপর একে একে উমাইয়া আব্বাসীয় ফাতেমীয় খিলাফতের অধীনে থাকে মাসজিদুল আকসা। ১০৯৫ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপের ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি সহ অন্য দেশগুলো মিলে জেরুজালেম শহর দখলে নিতে ক্রসেড যুদ্ধের সূচনা করে।

১০৯৯ সালের ১৫ ই জুন বায়তুল মুকাদ্দাস সহ গোটা জেরুজালেম দখল নিয়ে নেয় খ্রিস্টশক্তি। ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে ইয়ারমুকের যুদ্ধের ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু জেরুজালেম বিজয় করে অন্য ধর্মের মানুষদের শান্তিতে বসবাসের জন্য নিরাপত্তা চুক্তি করলেও, খ্রিস্টানরা জেরুজালেম শহর দখল করে ৭০ হাজারের অধিক মুসলিমদের নির্মমভাবে হত্যা করে। ঐতিহাসিকদের মতে সে সময় মুসলিমদের রক্তে কুসেট বাহিনীর ঘোড়াগুলোর পা রক্তাক্ত হয়ে যায়।

পরবর্তীতে আইয়ুবী মামলুক এবং উসমানীয় সুলতানদের অধীনে দীর্ঘদিন মুসলিমদের অধীনে ছিল বাইতুল মুকাদ্দাস। কিন্তু ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধের মাধ্যমে বায়তুল মুকাদ্দাসের কর্তৃত্ব হারায় আরববিশ্ব। আর জেরুজালেম শহর ফিলিস্তিনের অনেকগুলো অঞ্চল দখল করে নেয় ইজরাইল। আরব-ইসরাইল যুদ্ধের তৎকালীন পাকিস্তান বিমান বাহিনীর হয়ে লড়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের সাইফুল আজম। তিনি অসম সাহসিকতা এবং নৈপুণ্য দিয়ে ইসরাইলি উন্নত প্রযুক্তির বেশ কয়েকটি বিমান ভূপাতিত করে রেকর্ড গড়েছিলেন। এই সাহসিকতার জন্য তাকে লিভিং ঈগল উপাধি দেওয়া হয়েছিল।

মসজিদুল আকসার ইতিহাসে বর্তমান ফিলিস্তিন এবং ইসরাইল যুদ্ধ

বর্তমানে ইসরাইলে বসবাসকারী মুসলিম বাসিন্দা এবং পূর্ব জেরুজালেমে বসবাসরত অল্পকিছু ফিলিস্তিনিরা সাধারনত বায়তুল মোকাদ্দাসে প্রবেশ করতে পারে এবং নামাজ আদায় করতে পারে। তবে কখনো কখনো মুসলিমদের প্রবেশে বাধা প্রদান করা হয়, এই বিদেশিদের মাত্রা সময়ে সময়ে পরিবর্তন হয়, কখনো কখনো শুধু জুমার নামাজের সময় বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়। বর্তমানে এই মসজিদে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত। আখিরুজ্জামান বা শেষ জামানার ঘটনাবলীর কারণে ও জেরুজালেম এলাকাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শেষ জামানার ঘটনাপ্রবাহের পরিবর্তন ঘটবে আল-আকসা কে কেন্দ্র করে। এমনকি এই অঞ্চলে দাজ্জাল এবং ঈসা আলাইহিস সালামের আগমন ঘটবে। এই ভূমিকে বিস্তৃত করেই প্রস্তুত করা হবে হিসাবের মাঠ বা হাশরের ময়দান।

উসমানীয় খলিফাদের নিয়ন্ত্রণে আছে ষোল শতকের শুরুর দিকে। মক্কা, মদিনায় অবস্থিত দুই পবিত্র মসজিদের মতো করেই আল আকসার মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণে বিশেষ তৎপর ছিলেন অটোমান শাসকরা। ইহুদিদের নানামুখী কূট-ষড়যন্ত্র এবং প্রলোভনের মুখে শেষ স্বাধীন উসমানীয় সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদও আল আকসা রক্ষায় অত্যন্ত দৃঢ়চেতা ও অনমনীয় ছিলেন।

আল আকসাবাসীর ভাগ্যে নেমে আসে নতুন দুর্যোগ যখন উসমানীয় খেলাফত বিলুপ্তির হয়। এখনও চলমান আছে সেই দুর্যোগ। বর্তমানে ইহুদি সেনাদের ছাড়পত্র ছাড়া আল আকসায় দুই রাকাত নামাজও আদায় করা যায় না।

মসজিদুল আকসার ইতিহাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *